মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ০১:১৫ পূর্বাহ্ন

পি কে হালদারকে বন্দিবিনিময় চুক্তিতেই ফেরত আনা সম্ভব

নিজস্ব প্রতিবেদক, ই-কণ্ঠ অনলাইন ডেস্ক:: আর্থিক খাতে অর্থ লোপাটের অন্যতম খলনায়ক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি কার্যত জটিল বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, একমাত্র বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া তাকে ফিরিয়ে আনা দুরূহ হবে।

সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করে পি কে হালদার দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে যান। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কেউই বলতে পারেনি এই অর্থ পাচারকারীকে কবে নাগাদ ফেরত আনা যাবে। তবে তাকে ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।

ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) যা করছে

দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) থেকে ইন্টারপোলকে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির সুপারিশ করা হয়। এরপর ৮ জানুয়ারি পুলিশ সদর দফতর থেকে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

বর্তমানে এই প্রক্রিয়া কোন পর্যায়ে আছে, জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান বলেন, বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাকে ফেরত আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এ জন্য পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অরগানাইজেশন) সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। তবে বলার মতো কোনও অগ্রগতি এখনও হয়নি।

গত বছরের ১৪ মে পশ্চিমবঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে ধরা পড়েন পি কে হালদার। এরপর থেকেই ভারতের কারাগারে আছেন বাংলাদেশের আর্থিক খাতে দুর্নীতির এই খলনায়ক।

গত সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সংস্থা ইডি জানিয়েছিল, বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে পাঠানো হবে পি কে হালদারকে। তবে এমন আশ্বাসের কোনও আলামত দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালের অক্টোবরে ভারতের সঙ্গে বহিঃসমর্পণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। এই চুক্তির আওতায় দুই দেশের বন্দিবিনিময়ের সুযোগ রয়েছে।

যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ লোপাট করা হয়

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) এই চার প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে। সেসব অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে দেন তারা। দুদকের ৩৭টি মামলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ রয়েছে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে।

পি কে হালদার রিলায়েন্স ফ্যাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা (এমডি) পরিচালক ছিলেন। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এখন গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক নামে পরিচিত।

দুদক কী করছে

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পি কে হালদারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৭টি মামলা করে। দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বাধীন একটি টিম এসব মামলা করেন। এ ছাড়া পৌনে তিন শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়ায় দুদকের উপপরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরীর করা মামলাটিরও সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে আদালতে। কিছু মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। সেসব মামলার তদন্তে আরও অর্থ লোপাটের তথ্য বেরিয়ে আসছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এ ছাড়া পৌনে তিন শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়ায় দুদকের উপপরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরীর করা মামলাটিরও বিচার চলছে আদালতে।

তদন্তে সংশ্লিষ্ট দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পি কে হালদারের বিষয়ে যেখানে যেখানে চিঠি লেখা দরকার, তাগাদা দেওয়া দরকার, সেসব জায়গায় আমরা চিঠি দিয়েছি। কথা বলা অব্যাহত রেখেছি। এ ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই, ক্ষমতাও নেই। তা ছাড়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের করা মামলায় সেখানে পি কে হালদার কারাবন্দি আছেন। সেই মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। সেটা শেষ না করে মনে হয় না ভারত তাকে ফেরত পাঠাবে।

এই কর্মকর্তা মনে করেন, পি কে হালদারকে দেশে আনা গেলে লোপাট হওয়া টাকার কিছুটা হলেও উদ্ধার হতো। তার কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া কিছু রাঘব-বোয়ালের নামও বেরিয়ে আসতো।

দুদকের কমিশনার জহুরুল হক বলেন, পি কে হালদারকে ফেরানোর বিষয়ে দুদকের কাছে আপাতত নতুন কোনও তথ্য নেই। তা ছাড়া পি কে হালদারকে ফেরত আনার বিষয়টিও তাদের একক এখতিয়ারে নেই।

তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় আমরা চিঠি দিয়েছি। তাগাদাও দিচ্ছি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা কেউ তাকে ফেরত আনার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। এখন পর্যন্ত তাকে আনার ব্যাপারে আমরা কিছু করতে পারিনি। এ বিষয়ে আরও যাদের এখতিয়ার আছে, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছি, চেষ্টা করছি।

যা বললো টিআইবি

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পি কে হালদারের পালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো দায়ী। দেশ থেকে চলে যাওয়ার আগেই তাকে আইনের আওতায় আনার সুযোগ ছিল। তার চলে যাওয়াটা প্রতিরোধ করা যেতো। কিন্তু সেই সুযোগটা আমরা নিইনি।

তিনি আরও বলেন, পি কে হালদার যখন ভারতে গ্রেফতার হন, তখন সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছিল তাকে দ্রুত ফেরত আনা হবে। কিন্তু ভারতের সংশ্লিষ্ট আইন লঙ্ঘনের অপরাধে তার বিরুদ্ধে বিচারের প্রক্রিয়া চলছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ফেরত আনা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। এসব আইনি প্রক্রিয়া শেষ না করে ভারত তাকে ফেরত পাঠাবে, এটা ভাবা ঠিক হবে না।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুই দেশের যে বন্দিবিনিময় চুক্তি আছে, তার ভিত্তিতে ভারত সরকারের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া এ ধরনের অভিযুক্তকে ফেরত আনাটা দুঃসাধ্য ব্যাপার হবে। যার বিরুদ্ধে ভারতের আইন লঙ্ঘনের বিষয় আছে।

আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের আওতায় দুই দেশের পারস্পরিক আইনি সহায়তায় অভিযুক্তকে ফেরত আনা সম্ভব। কিন্তু সরকার আন্তর্জাতিক আইনের কতটুকু সহায়তা নেবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2020  E-Kantha24
Technical Helped by Titans It Solution