মঙ্গলবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১১:৫১ পূর্বাহ্ন
কবির হোসেন, সাজেক থেকে ফিরে॥ যাপিত জীবনের ক্লান্তি মুছে একটু সজীবতা পেতে চায় প্রাণ। ভ্রমণ ক্লান্ত প্রাণে দিতে পারে স্বস্তি। শুভ্র মেঘের পিছুপিছু ছুটে যেতে কার না ইচ্ছে করে। মেঘের ভেলায় হারিয়ে যেতে, আকাশের মেঘদের সাথে কথা বলতে চায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু কংক্রিটের এই শহরে মেঘেদের নাগাল পাওয়া দায়। মেঘ-পাহাড়ের রাজ্যের নাম সাজেক ভ্যালি। অনেকে সাজেক ভ্যালিকে বাংলাদেশের ভূস্বর্গ বলে থাকেন। আকাশের নীল যেন এখানে এসে দিগন্ত ছুঁয়েছে। চারপাশে যতদূর দৃষ্টি যায় ছোট-বড় সবুজ পাহাড়। উপর থেকে দৃষ্টি মেললে যেন সবুজ সমুদ্রের ঢেউ। একটি থেকে আরেকটি পাহাড়ের মাঝে যেন আটকে আছে সাদা মেঘের ভেলা।
দেশের বৃহত্তম ইউনিয়ন সাজেক। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় এ ইউনিয়ন। তবে সাজেকে যেতে হয় খাগড়াছড়ি সদর থেকে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা এবং বিকেল ৩টায় বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করার পর সকল গাড়ি একযোগে সাজেকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে গেছে আঁকা-বাঁকা পিচঢালা সড়ক। যাওয়ার পথে কখনো গাড়িগুলো আকাশের দিকে, কখনো পাহাড়ের গহীনের দিকে চলতে থাকে। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে পাহাড়ি শিশুরা হাত নেড়ে অতিথিদের অভিবাদন জানায়।
আঁকাবাঁকা সবুজ পাহাড়ি পথ ছুঁয়ে যায় মন-প্রাণ। খাগড়াছড়ির অপরূপ নিসর্গ প্রতিদিনই অগণিত পর্যটকের নয়ন জুড়ায়। শীতল বাতাস, নয়নাভিরাম দৃশ্য কাছে টানে পর্যটকদের। পাহাড়-টিলা, অরণ্য প্রকৃৃতির সৌন্দর্য বিধাতার নিপূণ হাতে গড়া যেন অন্য এক পৃথিবী। সবুজ উঁচু পাহাড়ের পাশ দিয়ে সাদা মেঘের ভেলা পর্যটকের গা ছুঁয়ে যায়। মেঘ-পাহাড়ের অপূর্ব মিতালী চোখে পড়ে খাগড়াছড়ি পেরিয়ে সাজেক ভ্যালি। দার্জিলিংকে হার মানায়! পার্বত্য এই জেলায় রয়েছে অসংখ্য পর্যটন ও বিনোদন স্পট। পাহাড়, ঝরণা, কৃত্রিম লেক, গুহা, গিরিখাদ আরও কত কী। এর মধ্যে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র, রিছাং ঝরণা, তৈদুছড়া ঝরণা, হাজাছড়া ঝরণা, আলুটিলার রহস্যময় সুড়ঙ্গ, জেলা পরিষদ পার্ক, মায়াবিন লেক, রামগড় কৃত্রিম লেক ও ঝুলন্ত সেতুসহ প্রতিটি পর্যটন স্পটে এখন পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়।
খাগড়াছড়ি থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথের শেষে সাজেক। সমুদ্রপিষ্ট থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় পাকা সড়কের দুপাশে পায়ে হেটে চলার জন্য রয়েছে পরিচ্ছন্ন ফুটপাত। পাহাড়িদের এবং পর্যটকদের জন্য রয়েছে রঙিন সব কটেজ। পাহাড়ের উপত্যকায় সাজানো-গোছানো শহরের নাম সাজেক। যা পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। সাজেকে রুইলুই ও কংলাক নামে দুটি পাড়া রয়েছে। পর্যটকরা অবস্থান করেন রুইলুই পাড়ায়। সেনাবাহিনী পরিচালিত সাজেক ও রুনময় নামে দুটি রিসোর্ট রয়েছে। সাজেকে থাকার জন্য প্রচুর রিসোর্ট, গেস্ট হাউস গড়ে উঠেছে। এসব রিসোর্ট গুলোর নামও সুন্দর। মেঘপুঞ্জি, হিলকটেজ, মেঘমালা, মেঘাদ্রি, টংথক, লুসাই, কাশবন, নীল পাহাড়ি-এরকম অনেক রিসোর্ট রয়েছে। এখানে বেশির ভাগই কটেজ বা রিসোর্ট কাঠ, খড় দিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি। ভ্যালির মূল রাস্তার দুপাশ জুড়েই রয়েছে রিসোর্টগুলো। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার জন্য যে যার পছন্দ মতো রিসোর্ট বেছে নেন। যারা রাস্তার ডান পাশের রিসোর্ট বা কটেজে ওঠেন তার পাহাড়-আকাশ ও মেঘের চমৎকার ভিউ-এর সাথে সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পান। অনেকেই তাই মেঘপুঞ্জি, লুসাই, টংথক রিসোর্ট-এ থাকার জন্য বেছে নেন।
সাজেক ভ্রমণে কংলাক পাহাড়ে ওঠার আনন্দটা অন্যরকম। আকাঁ-বাকা বিভিন্ন পথ ধরে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের চূড়াতে উঠতে হয়। যত কষ্টই হোক সবাই পাহাড়ের চূড়াতে পৌঁছাতে দ্বিধা করেন না। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য কম বেশি সবাই লাঠির সহযোগিতা নেন। কংলাক পাড়ায় গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য পায়ে হেটে পাহাড় বয়ে উঠতে হয়। সাজেকে এটাই সবচেয়ে উঁচুস্থান। কংলাক পাড়া থেকে এক নজরে সাজেক দেখার সুযোগ মেলে। তবে সাজেকে হ্যালিপ্যাডে পর্যটকরা গোধূলী বরণ করেন। এখানে বসেই দল বেধে গান ধরেন পর্যটকরা। সন্ধ্যা নামার পরে অনেকে ফানুস উঁড়িয়ে দেন। তবে অন্ধকারটা ঘনিভূত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই ফিরে আসেন রুইলুই পাড়ায়। এখানে সড়কের পাশে পাহাড়িরা কমলা, আনারস, কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফল বিক্রি করেন। পাহাড়ের এসব ফল খুব সুস্বাদু। সাজেক ভ্যালিতে থাকার জায়গা গুলো যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি খাবারও। খাবারগুলো পর্যটকদের অভিভূত না করে পারে না। বিশেষ করে বেম্বো চিকেন এবং বেম্বো টি এখানে বাড়তি আকর্ষণ। বেম্বো চিকেন পাহাড়ি বাঁশের মধ্যে মশলা-চিকেন একসাথে মাখিয়ে দিয়ে আগুনে বাঁশ পুড়িয়ে বিশেষভাবে রান্না করা হয়। বেম্বো চিকেনের স্বাদ একটু ভিন্ন। স্বাদে-গন্ধে অবশ্যই বৈচিত্র্যময়। একই ভাবে বেম্বো টি পান না করলে সাজেক ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়।
যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে সব জনপ্রিয় পরিবহনেরই খাগড়াছড়ি পর্যন্ত বাস সার্ভিস আছে যেমন-নন এসি আছে শ্যামলী, হানিফ, এস আলম, শান্তি পরিবহন ও ইউনিক ইত্যাদি আর এসি পরিবহনের মধ্যে আছে সেন্টমার্টিন, রিল্যাক্স, শান্তি পরিবহন ইত্যাদি। মুলত সবগুলো বাসই প্রতি রাতের এগারোটার মধ্যেই ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে যায় এবং ভোর ৬/৭ টা নাগাদ খাগড়াছড়ি নামিয়ে দেয়। ভাড়া নন এসি ৭৫০ টাকা আর এসি ১২৫০ টাকা। খাগড়াছড়ি থেকে আপনি তিন মাধ্যমে সাজেক পৌছাতে পারবেন। চান্দের গাড়ী, সিএনজি এবং মটরসাইকেলে। সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হলো খাগড়াছড়ি শহর বা দীঘিনালা উপজেলা শহর থেকে জীপগাড়ি (লোকাল নাম চাঁন্দের গাড়ি) রিজার্ভ নিয়ে ঘুরে আসা। ভাড়া নিবে পুরাতন চান্দের গাড়ী ৮০০০-৯০০০ টাকা আর নতুন মাহিন্দ্রা পিকআপ গুলো ১২০০০-১৩০০ টাকা, এই টাকার মধ্যে আপনি যাবেন তারপর রাত সাজেকে কাটাবেন গাড়ী আবার আপনাকে নিয়ে আসবে খাগড়াছড়িতে। এক গাড়িতে গাড়ীর সাইজ অনুযায়ী দশ থেকে ১৫ জন বসতে পারবেন। এই টাকার মধ্যে গাড়ী আপনাকে হাজাছড়া, রিসং ঝর্ণা, আলুটিলা, জেলা পরিষদ পার্ক ও ঝুলন্ত ব্রিজ ও তারেং ঘুড়িয়ে দেখাবে।
যদি কেউ এগুলো না ঘুরেন তাহলে ১০০০-১৫০০ টাকা কম লাগবে। গাড়ী আগে থেকে ঠিক করার দরকার নেই খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বরের জিপ সমিতি অফিসে গেলেই ওরা সব ঠিক করে দিবে। লোক কম হলে খাগড়াছড়ি শহর থেকে সিএনজি নিয়েও যেতে পারবেন। ভাড়া ৪০০০ টাকার মতো নিবে। এছাড়াও মটরসাইকেলে করে সাজেক ঘুরে আসতে পারবেন এক্ষেত্রে এক মটরসাইকেলে ড্রাইভার সহ তিনজন বসতে পারবেন ভাড়া আসা যাওয়া রিজার্ভ ১২০০-১৫০০ টাকা (দামদর করে নিবেন কম বেশি হতে পারে)। আপনিও যেতে পারেন দেশের এই মনোরম স্থানে। পাহাড়ি পথ বেয়ে বেয়ে যখন সাজেকে পৌঁঁছাবেন তখন সত্যিই হৃদয়ে অন্যরকম এক আনন্দ অনুভূত হবে। তবে এখানে যাওয়ার আগে সবকিছু ঠিকঠাক করে যাওয়া ভাল। বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর রয়েছে তাদের ব্যবস্থাপনায় গেলে অনেক সময় বাঁচবে। ঘুরেও আনন্দ পাবেন বেশি।