শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ০৯:৩৪ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধিঃ মানুষ বড়ই বিচিত্র জীব! নিজের স্বার্থের জন্য সবকিছুকে একমাত্র মানুষই ধ্বংস করতে পারে। এই মানুষের দ্বারা আজ ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের প্রকৃতি, আমাদের জীববৈচিত্র্য, আমাদের মহামূল্যবান প্রাণীজগৎ। নীতিমালা না মেনে প্রাকৃতিক জলভূমিগুলোকে ধ্বংস করে মানুষেরাই আজ তৈরি করছে কৃত্রিম মাছের প্রজনন কেন্দ্র। এতে করে জলচর পাখিগুলোর অবস্থা আজ মারাত্মক হুমকির মুখে।
আমাদের দেশের বিরল আবাসিক পাখি দলপিপি। এরা জলাভূমির পাখি। এদের অবস্থায় সেরকমই। নিরাপদ বিচরণভূমির অভাবে তাদের প্রজনন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। দলপিপির ইংরেজি নাম Bronze-winged Jacana এবং বৈজ্ঞানিক নাম Metopidius indicus। শত্রু উপস্থিতি বা ভয় পেলে এরা কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে পাতার আড়ালে লুকিয়ে ফেলে। বিলের পানিতে শরীর ডুবিয়ে দিয়ে মাথা তুলে পরিস্থিতি অবলোকন করতে থাকে।
বৃত্তাকার শাপলা-পদ্মের পাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কাছে-দূরে। তার উপর দিয়েই দ্রুত বেগে ছুটাছুটা করছে জলচর দলপিপির দল। তাদের কণ্ঠে কখনো বাঁশির সুরের মতন ডাকাডাকি। আবার কখনো নিঃশব্দে শিকারের সন্ধান। স্থির হয়ে এটা জায়গায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালে মনে হয়- মাটির শক্ত আবরণের উপর যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে কোনো পাখি। বিলের পাতার উপর দিয়ে তাদের এমন হেঁটে যাবার দৃশ্যটি বড়ই মনোরম।
প্রখ্যাত পাখি গবেষক এবং লেখক ইনাম আল হক বলেন, ‘এরা বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। বাইক্কা বিল ও টাংগুয়ার হাওর এই দুটো জাগয়াই এরা ভালো সংখ্যায় রয়েছে এবং এখানেই ওরা প্রজনন ঘটিয়ে থাকে। অন্য জায়গাগুলোতে এরা নেই বললেই চলে। এরা পাতার উপর ডিম পাড়ে। নিরাপদ এলাকা ছাড়া এরা ডিমও পাড়তে পারে না। বাচ্চাও হয় না। সংরক্ষিত এলাকা ছাড়া এদের আর কোথাও প্রজননের সুযোগ নেই। আগে এরা প্রায় সব বিলেই থাকতো। কিন্তু এখন যেহেতু নিরাপদ বিল আর নেই সেহেতু একেবারেই এরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এরা বাসা না করে একেবারে ভাসমান পদ্মপাতার উপর খোলা অবস্থায় ডিম পাড়ে। ছেলেপাখি ডিমে তা দেয়। তিন সপ্তাহ পরে ছানা বের হয়। ছানাগুলোও জলজ পাতার উপর হাঁটাচলা করে বড় হয়। বাংলাদেশে তিনটি পাখি রয়েছে যাদের ছেলেপাখিরা ডিমে তা দিয়ে ছানা ফুটায়। এরা হলো দলপিপি, নেউপিপি এবং রাঙাচ্যাগা। ৫-৬ সপ্তাহ খোলা জায়গায় থেকে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। সেক্ষেত্রে সংরক্ষিত জায়গাগুলোই তাদের প্রজননের একমাত্র ভরসা। তবে প্রাকৃতিক শত্রু গুইসাপ, ঈগল, চিল প্রভৃতির আক্রমণও রয়েছে।’
ইনাম আল হক আরো বলেন, ‘প্রাকৃতিক এসব শত্রুর চেয়েও বিপজ্জনক হচ্ছে মানব শত্রু। শাপলা, পদ্ম প্রভৃতি এসব জলজ উদ্ভিদের পাতা মানুষ এখন বিল থেকে তুলে ফেলে। ফলে এদের চলাচলে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। বিলের আশেপাশে মানুষের অবাধ বিচরণ এদের ক্ষতির আরেকটি অন্যতম কারণ। এতোসব মানুষ এখন বিলে নামে যে এরা নিজেদের বিলের সাথে আর খাপখাওয়াতে পারে না। বিল-হাওর-জলাশয়ে মানুষ সংখ্যায় বেশি বলেই এদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। বাইক্কা বিল এবং টাংগুয়ার হাওর ছাড়া অন্য বিলে এরা অল্প সংখ্যায় আছে কিন্তু প্রজনন ঘটাতে পারছে না। ফলে অদূর ভবিষ্যতে এরা আর টিকে থাকবে না।’
দলপিপির দৈর্ঘ্য ২৮ সেমি. এবং ওজন ১৫৫ গ্রাম। এরা মাঝারি আকারের জলচর পাখি। লম্বা পা এবং আঙুলের অধিকারী। পোকা, শামুক জাতীয় ছোট প্রাণ, উদ্ভিদের বীজ ও অঙ্কুর খেয়ে থাকে। জুন-জুলাই মাস এদের প্রজনন মৌসুম। বাদামি রঙের চারটি ডিম পাড়ে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদের বিচরণ রয়েছে বলে পাখিবিদ ইনাম আল হক জানান।